ফিচার
৯০ বছর আগে যেভাবে আধুনিক কাওয়ালির শুরু
নব্বই বছর আগে সৈয়দ নূরুল হাসান নামে একজন সুফি ‘নাগমত-উস-সামা (শোনার জন্য গান)’ নামে ফারসি শ্লোকের একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার এই পেটমোটা বইয়ে ৭০০টিরও বেশি সযত্নে বাছাইকৃত ফারসি কবিতা রয়েছে, যা তিনি উত্তর ভারতের মাজার এবং অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর সুফি হযরত আলাউদ্দিন সাবির কালিয়ারির স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে এই ‘নাগমত-উস-সামা’। উত্তরাখণ্ডের পিরান কালিয়ারে তার মাজারে গিয়েই নূরুল হাসান এই সংকলনটি তৈরি করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
‘সামা’, আরবি থেকে উদ্ভূত একটি জটিল শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ ‘শ্রবণ’। কিন্তু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এর অনেক ধরনের অর্থ হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় কার্যাবলি এবং গান। শ্রোতাদেরকে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে চলে যাওয়ার অবস্থা উল্লেখ করতেও ব্যবহৃত হয় এই শব্দটি।
নূরুল হাসানের ১৯৩৫ সালের এই সংকলনকে সেই বিভিন্ন ধরনের একটি মিশ্রণ বলা যেতে পারে। এর মূল অংশ গজল হলেও অন্যান্য বেশ কয়েকটি কাব্যিক ধারাও রয়েছে, যেগুলোকে একত্রে নাগমা (গান) বলা হয়। এর সাংগীতিক ভাব ও জনপ্রিয়তাকে প্রাধান্য দিয়েই এগুলোকে নির্বাচন করা হয়েছে। তবে এতে স্থান পাওয়া নাগমা ও গজলগুলোর বড় একটি অংশ উত্তর ভারতের বিভিন্ন মাজারে গাওয়া হয়।
নূরুল হাসান তার সংকলিত বইয়ের ভূমিকায় অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে স্বীকার করেছেন যে তিনি যেভাবে পেরেছেন, তার সবগুলোই সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছেন। এগুলো তিনি মাজারে শুনেছেন এবং ‘মাইকাশ’ আকবরাবাদীর মতো পণ্ডিত তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। তিনি এ-ও স্বীকার করেছেন যে, বেশ কয়েকটি গানের জন্য তিনি তিন বা চারটি শ্লোকের বেশি সংগ্রহ করতে পারেননি, এমনকি এর মূল কবিদের সম্পর্কেও কোনো বিবরণ খুঁজে পাননি।
পাঠকদের কাছে হাসানের অনুরোধ
বইটি তার পাঠকদের কাছে একটি গুজারিশ (অনুরোধ) দিয়ে শুরু হয়েছে, যাতে ভারতের ফারসি ভাষা সম্পর্কে আক্ষেপ করে হাসান লিখেছেন:
‘সময় বদলেছে, আমাদের সময়ের মানুষ বদলেছে, কবিতার স্বাদ বদলেছে। এখন আর সেই মাশায়েখ (সাধক) নেই, সেই পৃষ্ঠপোষক, আরবাব-এ-হাল (অনুসন্ধানী) নেই, নেই সেই গায়ক কিংবা সেই শ্রোতারা। তারপরও, এই পৃথিবীতে কেউই ঐশ্বরিক সুবাস থেকে মুক্ত নয়। তাই যেসব পবিত্র আত্মা (সংকলিত গান) এখনো অবশিষ্ট আছে, যেগুলোকে আমি দীর্ঘকাল ধরেই চিনতে পেরেছি, আমি সেই আহলে-হালদের (অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় আশীর্বাদপ্রাপ্ত ব্যক্তি) ফারসি লেখাগুলোকে একটি সংকলনে একত্রিত করতে চেয়েছিলাম। এই লেখাগুলো আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ এবং প্রতিটি শব্দ ঐশ্বরিক গানের সাথে অনুরণিত হয় এবং তাদের গানের সাথে মিলে যায়।’
গুজারিশটি তার সময়ের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে, যখন ফারসি ভাষার প্রতি এবং একইসাথে ভাষাটি বোঝার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গিয়েছে। এবং বাস্তবতা হলো, সংকলনটি রচনার পর থেকে ভারতে ফারসি ভাষার অবস্থান আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। নৃতাত্ত্বিক সংগীত বিশেষজ্ঞ রেগুলা কুরেশি যেমনটি উল্লেখ করেছেন, ‘সামা’ রচনার প্রধান ভাষা ফারসি একসময় শ্রোতাদের মার্জিত ও পরিশীল রুচির চিহ্ন এবং উচ্চ মর্যাদার ভাষা হিসেবে পরিগণিত হতো। তবে সত্তরের দশকের পর ভারতে এর পৃষ্ঠপোষক, সংগীতশিল্পী এবং শ্রোতাদের কাছে সেই মর্যাদা হারিয়ে যায়।
গিরা খোলা
হিন্দুস্তানি সংগীতের অন্যান্য বেশিরভাগ ঘরানার মতোই কাওয়ালিও মূলত একটি ইন্টারঅ্যাক্টিভ অভিজ্ঞতা: অভিনয়শিল্পীরা শ্রোতাদের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য বেশ কিছু কৌশল প্রয়োগ করেন। এরকমই একটি কৌশল হলো মূল শ্লোকের বার্তা আরও অর্থবহ করার জন্য গিরাহ (নতুন শ্লোক যোগ করা) প্রবর্তন করা।
কাওয়ালিতে এখনও যে সামান্য ফারসি গাওয়া হয়, সেটিও গাওয়া হয় গিরা হিসেবে টুকরো টুকরো করে, এগুলোও আবার হিন্দি বা উর্দুতে; অথবা দর্শকদের আগ্রহ যাচাই করার উপায় হিসাবে। শ্রোতাদের মধ্যে যদি ফারসি ভাষা আগ্রহ না জাগায়, তখন তারা হিন্দি বা উর্দুতে গাওয়া শুরু করেন। বর্তমান সময়ের কাওয়ালিতে ব্যবহৃত ফারসি গিরার সবগুলোই উঠে এসেছে নূরুল হাসানের ‘নাগমত-উস-সামা’ থেকে।
সৈয়দ নূরুল হাসান (পুরো নাম সৈয়দ নূর উল-হাসান মওদুদী সাবরি ফজল-ই-রেহমানি সহসাওয়ানি) নিজেই স্বীকার করেন, তিনি মোটেই সংগীতজ্ঞ বা ফারসি সাহিত্যের কর্তৃপক্ষ নন। তিনি একজন পেনশনভোগী এবং সুফি, যিনি তার বার্ধক্যের অবসর সময়কে কাজে লাগিয়েছিলেন সংকলনটি রচনার জন্য, যাতে তিনি উত্তর ভারতের মাজারগুলোতে পারস্যের গানের যে টুকরো টুকরো পরিবেশন শুনেছিলেন, তার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। এমনকি তার নিজের জীবদ্দশাতেও এই সামাগুলো বিস্মৃত হওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল।
বইটির প্রথম সংস্করণ ১ হাজার কপি মুদ্রিত হয়েছিল। পাঠকদের কাছে তিনি অনুরোধ করেছিলেন এর ভুলগুলো শুধরে দেওয়ার জন্য এবং আরও গান পাঠানোর জন্য, যেগুলো এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। তবে সেই দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ আর শুরু করতে পারেননি সৈয়দ নূরুল।
ফারসি গানের সংকলন
সৈয়দ নূরুল হাসানের বইটি এর বিষয়বস্তুর মতোই ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে থেকে যাবে। যে সময় দক্ষিণ এশিয়ায় ফারসি ভাষার ব্যবহার কমে যাচ্ছে, তখন এটি হয়ে উঠেছে উপমহাদেশের কাওয়ালি সংগীতজ্ঞদের মূল পাঠ। কারণ বর্তমান সময়ে এই উপমহাদেশে এমন কোনো জনপ্রিয় ফারসি কাওয়ালি গাওয়া হয় না, যা তার বইয়ে নেই।
যদিও ফারসি শ্লোকের আরও অনেক সংকলন রয়েছে, তারপরও সংগীতের মূর্ছনার ওপর তার বিশেষ নজর, এবং বেছে বেছে সহজলভ্য, জনপ্রিয় ও সহজেই সংগীতের ছাঁচে ফেলে দেওয়া যায় এমন গান নির্বাচন করাটাই তার বইকে পরিণত করেছে আধুনিক ফারসি কাওয়ালির ‘মূলপাঠ্য’ হিসেবে।
কাওয়ালি গাওয়ার জন্য পরবর্তী সমস্ত সংকলন, যেমন সত্তরের দশকে ভারতের ইদ্রিস খান এবং পাকিস্তানের মুশতাক ইলাহি ফারুকীর একই নামের সংস্করণগুলো তার বইয়ের ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে। এটি বর্তমান সময়ের ‘ফারসি কাওয়ালির ক্যাননের (মূলবই) জনক’ হিসেবে নূরুল হাসানের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।
‘নাগমত-উস-সামা’ কেবল আধুনিক সংগীতে ফারসি ভাষার গ্রহণযোগ্যতাকেই টিকিয়ে রাখেনি, বরং ‘জিগার’ মোরাদাবাদী এবং ‘মাইকাস’ আকবরাবাদীর মতো লেখকদের ফারসি রচনাগুলোকেও জনপ্রিয় করে তুলতে অবদান রেখেছে। যদিও সংকলনের বেশিরভাগই ইরানি পণ্ডিতদের শাস্ত্রীয় রচনা নিয়ে গঠিত, এতে বেশ কিছু ভারতীয় সুফি ও ভারতীয় ফারসি ভাষার কবির রচনাও রয়েছে।
শ্রদ্ধা নিবেদন
নূরুল হাসান যা শুনেছেন, ঠিক তা-ই বিশ্বাস করে লিখেছিলেন। তবে তাকে কেবল মাজারে মুখে মুখে ঘুরতে থাকা শ্লোকের সংকলনকারী বললে ভুল হবে। তিনি তার সংকলনে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন: লাইন বাদ দিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে কঠিন শব্দগুলোকে প্রতিস্থাপন করেছেন সহজ শব্দ দিয়ে; এবং অনেক ক্ষেত্রে, গানের রচয়িতাকে ভুলভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং একাধিক রচনাকে একসাথে মিশিয়ে ফেলেছেন। তবে এটি সম্ভবত অসাবধানতার কারণে নয়, বরং বিগত কয়েক দশক ধরে চলা গানের বিবর্তনের ফলেই হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চদশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কবি জামির ৫০টিরও বেশি কবিতা বা গান এই সংকলনে রয়েছে—যার মধ্যে ১৫টি রচনা তার নয়। এমনকি এই প্রবন্ধের প্রারম্ভিক পঙক্তিগুলো, যেগুলো দেওয়ান-ই-শামস-তাবরিজির একটি ‘সামা’র অংশ হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তার একটি আয়াত রুমির লেখা নয়।
ঐতিহ্য অনুযায়ী, একজন কবি একজন গুরুর প্রতি সবচেয়ে বড় যে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে পারেন, তা হলো একজন প্রতিষ্ঠিত কবির কাজগুলোর ওপর নতুন করে কাজ করা, তা থেকে ধার করা এবং উপস্থাপনের মাধ্যমে তার শৈলীর অনুকরণ করা। যদিও এ ধরনের জিনিস বর্তমান যুগে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়, কিন্তু তার সময়ে একে ত্রুটি হিসাবে দেখা হতো না, বরং শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের একটি রূপ হিসেবেই চিহ্নিত করা হতো।
তবে নূরুল হাসান যদি বেঁচে থাকতেন এবং দেখতে পেতেন কীভাবে তার সৃজনশীল স্বাধীনতাগুলো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে এবং তার সংকলনটি পরবর্তী প্রজন্মের সংগীতশিল্পীদের জন্য বিপুল সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে দিয়েছে, তাহলে তিনি সম্ভবত রোমাঞ্চিত হতেন।
ফিচার
ফিলস লাইক তাপমাত্রা মাপা হয় যেভাবে!
বছরের মাঝামাঝি সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চলে গরমের তীব্রতা। তাপমাত্রা এমন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনজীবন আজ বিদ্ভস্ত। চলতি বছরে দেশের কয়েক জেলায় তাপমাত্রার রেকর্ড মাপা হয়েছে সর্বোচ্চ ৪২ ডিগ্রি। আর এ কারণেই জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্ট ।
ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে মানুষ এখন আবহাওয়া পূর্বাভাসের জন্য বসে না থেকে ঘন ঘন মোবাইল ঘেটে দেখে নেয় তাপমাত্রার আপডেট। ধরুন, গুগলে সার্চ দেয়ার সময় তাপমাত্রা দেখা গেলো ৩৮ ডিগ্রিতে তবে এর অনুভুতি হচ্ছে যেন ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা।
এই যে ফিলস লাইক বা অনুভূত তাপমাত্রার কথা বলা হচ্ছে, সেটি আসলে কি? গরমের এই সময়ে কোন এক এলাকার যে নির্দিষ্ট যে তাপমাত্রার হিসাব দেয়া থাকে তার চেয়ে ফিলস লাইক তাপমাত্রা বেশিই থাকে। এই যেমন গুগল বলছে, এখন ঢাকার তাপমাত্রা ৩৮, কিন্তু ফিলস লাইক ৪২, অর্থাৎ চার ডিগ্রি বেশি!
কীভাবে এই ফিল্স লাইক মাপেন আবহাওয়াবিদরা? ব্রিটেনের আবহাওয়া অফিস বলছে, ফিল্স লাইক মাপা হয় কোনও এলাকার সম্ভাব্য তাপমাত্রার পূর্বাভাস, ওই এলাকার আর্দ্রতা ও হাওয়ার গতিবেগ মেপে।
তাপমাত্রা বলতে বোঝায় কোনও নির্দিষ্ট এলাকার বাতাসের তাপমাত্রা। কিন্তু রাস্তাঘাটে বেরুলে শুধু হাওয়া নয়, আরও কিছু বিষয় তাপমাত্রায় প্রভাব ফেলে। বাতাসের আর্দ্রতা ও গতিবেগের কারণে মূল তাপমাত্রার চেয়েও বেশি গরম বা ঠাণ্ডা অনুভূত হয়ে থাকে। পরিবেশেরও একটা বিরাট প্রভাব আছে এতে।
কীভাবে অনুভূত তাপমাত্রাকে প্রভাবিত করে বাতাসের আর্দ্রতা এবং হাওয়ার গতি?
আবহাওয়াবিদদের মতে, বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে ঘাম বেশি হয়। কিন্তু সেই ঘাম বাষ্পের সঙ্গে মিশে যেতে সময় বেশি লাগে। শরীর ঠান্ডা হতে পারে না, তখন গরম কিছুটা বেশি লাগে। অস্বস্তির পরিমাণও বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ-ভারতে যখন তাপদাহে পুড়ছে, তখন মরুর দেশ আরব আমিরাত আর সৌদি আরবের রুক্ষ দেশে অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি। এতোটাই বৃষ্টি যে দেশগুলো রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে রীতিমতো বন্যা পরিস্থিতি। আবার ইউরোপেও এবার অস্বাভাবিকভাবে প্রত্যক্ষ করছে বন্যা, যা এক সময় তাদের চিন্তারও বাইরে ছিলো।
ফিচার
জীবনযোদ্ধার আরেক নাম ‘বাবা’!
শব্দটি ছোট, অথচ এর অর্থ অনেক বিস্তৃত। পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকে যে মানুষটা সন্তানের একটু সুখের জন্য, পরিবারের চাওয়া-পাওয়া পূরণের জন্য নিজের সব সুখ ও স্বপ্ন বিসর্জন দেন, তিনি আর কেউ নন, ‘ বাবা’।
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন আর নতযানু হওয়ার দিন। শব্দটি ছোট, অথচ এর অর্থ অনেক বিস্তৃত। ভাষা আর স্থানভেদে ছোট্ট একটি শব্দের উচ্চারণ বদলে গেলেও অর্থ, বদলায় না রক্তের টান।
বাবা শব্দের মাঝেই জড়িয়ে আছে ভালোবাসা, মায়া, নির্ভরতা। বাবা হলেন সেইজন যার শক্ত কাঁধ সন্তানকে সামনে চলতে শেখায়। যার অক্লান্ত পরিশ্রম সন্তানকে সুন্দর একটা জীবন দেয়। যার অসীম ত্যাগ একটা সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত এনে দেয়।
‘বাবা’ ডাকলেই কেমন এক শান্তি আর আস্থার নিঃশ্বাস যেন অনুভূত হয়। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন। বাবা এক মায়ার নাম, এক ছায়ার নাম, চোখের সামনে ভেসে ওঠা এক জীবনযোদ্ধার নাম।
বাবা মানেই সব আবদারের জায়গা। সন্তানের জন্য এক পৃথিবী সমান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বাবা নামের বটবৃক্ষ। জীবনের সব রং-চাওয়া পাওয়া হাসি মুখে বিসর্জন দিতে পারেন বাবারাই। বাবার আর্দশ সন্তানকে ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে শেখায়।
প্রতি বছরের জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় বাবা দিবস। সে হিসেবে আজ রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, ভারতসহ প্রায় ১১১টি দেশে এ দিনেই বাবা দিবস উদযাপন করা হয়। তবে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ সেপ্টেম্বরের প্রথশ রোববার বাবা দিবস পালন করে থাকে।
বাবা দিবসের শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। তবে ঠিক কবে থেকে এ দিবসটির প্রচলন হলো তা নিয়ে দ্বিধা আছে। কেউ কেউ বলেন, ১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় চার্চের মাধ্যমে দিনটির প্রচলন। অন্যরা বলেন, ওয়াশিংটনের ভ্যাংকুবারে প্রথম বাবা দিবস পালন করা হয়। তবে সাধারণ মত, বাবা দিবসের প্রবক্তা সোনার স্মার্ট ডোড। ১৮৮২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্ম নেন। তার পিতা উইলিয়াম জেকসন স্মার্ট (১৮৪২-১৯১৯) ছিলেন কৃষক। মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় তিনি বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ডোডের মা অ্যালেন ভিক্টোরিয়া চেক স্মার্টসহ পুরো পরিবার চলে যান ওয়াশিংটনের স্পোকেনে। সেখানেই জন্ম হয় সোনার স্মার্ট ডোডের। যখন তার বয়স ১৬, তখন তার মা ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। পরিবারে সোনারই ছিলেন একমাত্র কন্যা। পূর্ব ওয়াশিংটনের এক গ্রামের ফার্মে এরপর থেকে তিনি নবজাতকসহ পাঁচটি সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব তুলে নেন। সোনারা বড় হওয়ার পর অনুভব করলেন ছয়টি সন্তান একা একা মানুষ করতে কী ভীষণ পরিশ্রমই না তার বাবাকে করতে হয়েছে। উইলিয়াম তার মেয়ের চোখে ছিলেন সাহসী, নিঃস্বার্থ একজন ভালো বাবা, যিনি সন্তানদের জন্য নিজের সব সুখ-শখ, আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছিলেন। সোনার স্মার্ট বিয়ে করেন জন ব্রোস ডোডকে। তাদের সন্তান জ্যাক ডোড জন্মের কিছুকাল পরে সোনারের স্বামীও মারা যান। এ অবস্থায় বাবা আর মেয়েতে মিলেই পুরো জীবন পার করে দেন।
বাবার প্রতি সম্মান জানাতে ‘বাবা দিবস’ ঘোষণার বিষয়টি সোনারের চিন্তায় আসে ১৯০৯ সালে। ‘মা দিবস’-এর অনুষ্ঠানে সে বছর চার্চে যান সোনার ডোড। অনুষ্ঠানে এসেই তার মনে হয় মা দিবসের মতো বাবাদের জন্যও একটি দিবস করা প্রয়োজন। যেখানে মায়েদের মতো বাবাদেরও সম্মান জানানো হবে। প্রকাশ করা হবে ভালোবাসা। যুক্তরাষ্ট্রের স্পোকেন মন্ত্রীজোটের কাছে তিনি তার পিতার জন্মদিন ৫ জুনকে বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব পাঠান। তার প্রস্তাবের প্রশংসা করলেও মন্ত্রীজোট ৫ জুনকে বাবা দিবস ঘোষণা করতে রাজি হয়নি। তারা জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। একটি স্থানীয় পত্রিকা সেদিন ছুটি ঘোষণা করে এবং বিভিন্ন দোকানিরা বাবাদের জন্য নানা রকমের উপহার সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে রাখেন।
১৯ জুন ১৯১০। প্রথম বাবা দিবস উদযাপিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পোকেনস শহরে। শহরের তরুণ-তরুণীরা দুটি করে গোলাপ নিয়ে যান চার্চে। একটি লাল, অন্যটি সাদা। লাল গোলাপ জীবিত পিতাদের শুভেচ্ছার জন্য, আর সাদা গোলাপ মৃত পিতাদের আত্মার তুষ্টির জন্য। বিষয়টি পুরো মার্কিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সবাই মিলে এই ভাবনার প্রশংসা করেন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে তা শুরু হয়। কিন্তু তারপরও এটাকে জাতীয়ভাবে পালনে কংগ্রেসের নানা দ্বিধা ছিল। কেননা তারা ভাবছিলেন এতে বাবা দিবস একটি বাণিজ্যে পরিণত হতে পারে। ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিষয়টি অনুমোদন করেন। ১৯২৪ সালে প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কোলিজ এটিকে জাতীয় দিবসে রূপ দেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন রাষ্ট্রীয়ভাবে জুনের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস উদযাপনের ঘোষণা দেন। অবশেষে ১৯৬৬ সালে ৫৬ বছর পর বাবা দিবসকে জাতীয় মর্যাদা দেয়া হয়। সোনারা ডোড মারা যান ১৯৭৮ সালে। তখন তার বয়স ছিল ৯৬ বছর।
ফিচার
বর্ষার ছন্দে এসেছে আষাঢ়ে মেঘের ভেলা!
বাংলা পঞ্জিকা না খুললেও প্রকৃতি যেন একটু একটু করে বলছে আষাঢ় এসে গেছে। সকালে আকাশ মেঘলা জানিয়ে দিয়ে আজ শনিবার (১৫ জুন) বাংলা তৃতীয় মাসের আর্বিভাব ঘটে গেছে। বৃষ্টি না থাকলে মেঘলা মেঘলা একটা অনুভূতি কিন্তু আছে।
আর তাই হয়তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন, ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে। এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে। ‘
ঋতুচক্রে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। আষাঢ় মানে বিশাল আকাশে কালো মেঘের পালকিতে ভেসে বেড়ানো মুহুর্মুহু ডঙ্কা-নিনাদ, ঝমঝম বৃষ্টি। বর্ষার শীতল জলে নবজীবন লাভ করে পল্লবপুঞ্জ। প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত, সতেজ ও শত সহস্র মনের প্রেমে ভিজিয়ে রাখার সাধ্য যে একমাত্র আষাঢ়েরই আছে, তা অস্বীকার করার সাধ্যি কার। কদম, কেয়া আর কেতকীর নয়নাভিরাম রূপের পসরা ও পেখম খোলা ময়ূরের উচ্ছল নৃত্যের আবাহন নিয়ে আসে বৃষ্টি।
আষাঢ় শব্দটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। আষাঢ় বাংলা সনের তৃতীয় মাস। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে জুন-জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আষাঢ় আসে।
বছরভর বাংলার প্রকৃতি হাজির হয় ভিন্ন ভিন্ন অপরূপ সাজে। তার মধ্যে বর্ষার সজল, শ্যামল রূপ অনন্যতায় ভরপুর। ধানের ক্ষেতে রৌদ্র-হাওয়ার লুকোচুরির মতো অপার্থিব দৃশ্য আর কখন মেলে! আষাঢ় আর শ্রাবণ দুই মাসজুড়ে ব্যাপ্তি বর্ষার। মাস দুয়েক নানা মাত্রায় বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর। টিপটিপ, ঝিরিঝিরি, ইলশেগুঁড়ি, মুষলধার—বর্ষার বারিধারার কতই না নাম! কবিরা তার মধ্যে শোনেন নূপুর, মৃদঙ্গ আর মাদলের বোল। আকাশের চেহারারও সে কী বৈচিত্র্য! সারাদিন ঘোলাটে থেকে শুরু করে ছাইরঙা হয়ে মোষের মতো কালো। বর্ষার প্রকৃতিতে ডাকাতের মতোই দৌরাত্ম্য চলে মেঘেদের। কখনো কখনো বর্ষণ শেষে সেই মেঘের ফাঁকে হঠাৎ উঁকি দেয় আকাশজোড়া স্বর্গীয় রঙধনু।
একালে অবশ্য আমাদের কেবল বর্ষা নিয়ে কাব্যকথায় বুঁদ হয়ে থাকলে চলে না। বিশেষ করে নগরে বর্ষা মানে মাথায় রাখতে হয় যানজট আর জলজটের কথা। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই নাকি গ্রীষ্ম-বর্ষা জুড়ে বেড়ে চলেছে বজ্রপাত আর তাতে হতাহতের সংখ্যাও।
টিআর/
মন্তব্য করতে লগিন করুন লগিন